আর কত নির্যাতনের শিকার হবে নারীরা?

নিপীড়ন, নির্যাতন আজ নারীর চলার পথের নিত্যদিনের সঙ্গী। একদিকে আমরা নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করছি সর্বপর্যায়ে আর অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও বৃদ্ধি করতে ব্যস্ত হীন মানসিকতার এক শ্রেণীর গোষ্ঠী। আসলে ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, নিপীড়ন কোনো কিছু দ্বারাই সম্বোধন করে এর ভয়াবহতা বর্ননাতীত যার কোনো সংজ্ঞা নেই। নেই কোনো বর্ণনার ভাষা।
হয়রানি বা নিপীড়নের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আর নারীর জীবনে নেই। যার প্রভাব তাকে বাকি জীবন ভোগ করতে হয়। এতে একজন নারীই শুধু  ক্ষতিগ্রস্ত হয়না তার সাথে সাথে এর প্রভাব পড়ছে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে।  নারীর শারীরিক, মানসিক, অবাধ স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তার পথে এ হয়রানি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। কখনো আত্মহননের মধ্য দিয়ে একজন নারী এর চূড়ান্ত সমাধানের পথ বেছে নিচ্ছে।
অসংখ্য কিশোরী যৌন হয়রানি বা ইভটিজিং কী সেটি বুঝে ওঠার আগেই সে ঝরে যাচ্ছে এ সমাজ থেকে। কখনো বিদায় নিচ্ছে জীবন থেকে, যে বিদায় নৃশংস কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘটছে। এমন পরিণতির একটাই কারণ তারা মেয়ে। কিছু নৃশংস পৈশাচিক মানুষের জঘন্য দৃষ্টির শিকার তারা। কখনো ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ছেলেরা এটি করছে, কথিত প্রেমের দোহাই দিয়ে করা এমন জঘন্য কর্মের শেষ নেই। আইন, নিষেধাজ্ঞা এ ঘটনাকে প্রতিরোধ না করে বাড়িয়ে দিচ্ছে এর গতিকে। একটি ঘটনা আর একটি ঘটনাকে মনে হচ্ছে যেন এগিয়ে নিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ প্রণীত হলেও নারীর সেই প্রকৃত মানবাধিকার আজো রক্ষা হয়নি, প্রতিষ্ঠাও হয়নি।
ইভটিজিং বন্ধে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনে দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা সংযোজন করা হয়, যা কার্যকর হয় ০৯ নভেম্বর ২০১০ থেকে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড। এর আগে ২০০৯ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ, টিজ করাকে যৌন হয়রানি হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ ছাড়া কারো সুস্থ মানসিকতা গড়ে ওঠে না। পরিবারই যার প্রধান ভিত্তি। এর পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সঙ্গী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ যারা নিপীড়নকে আনন্দ উপভোগের উপায় ভাবে বা বাহাদুরি জাহির করে তারা কোনো সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠেনি। প্রয়োজনীয় নৈতিক মূল্যবোধ ও সহমর্মিতার শিক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
কখনো কখনো নারীর পোশাক-আশাক বা চলাফেরাকে নারীর হয়রানির পেছনের কারণ মনে করা হয়। এটি অবশ্যই কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়। সুস্থ মানসিকতার অভাব হলেই মানুষ এধরণের মন্তব্য করতে পারে।
আইনই একমাত্র নারীর প্রতি হয়রানি প্রতিরোধে সর্বশেষ সমাধান নয়। আইন মানুষকে বড়জোর ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখতে পারে। যেখানে জরিমানার মাধ্যমেই তার কার্যকারিতা শেষ হয়ে যায় অনেক সময়। আইন প্রয়োগেও রয়েছে নানা রকম ঝামেলা। সর্বসাধারণের সহযোগিতা, সচেতনতা ছাড়া এ সংক্রামক রোগ নির্মূল করা যাবে না । যৌন নিপীড়নকে সঠিক নামে, সঠিক গুরুত্ব দিয়ে চিহ্নিত করা অনস্বীকার্য। নারীর অনুভূতি, সম্মতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্বও আমলে নিতে হবে। নারীকে দুর্বল ভেবে বা ক্ষমতাহীন ভেবে এখনো ছোট করা হয়। এসব কথিত প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এরূপ নিপীড়নের সহায়ক। নারী প্রতিবাদ করবে না, অভিযোগ করবে না, শুধু নীরবে সহ্য করবে আর নির্যাতিতকে হাসপাতালে ভর্তি করে বড়জোর চিকিৎসা সহায়তার আশ্বাস দেবে- এমনতো হওয়া উচিত নয়।
নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়। কখনো কখনো আসামিরা জেলও খাটে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাঝপথে থেমে যায় মামলার গতি। আমরা জানি বেশিরভাগ ঘটনা পরিবারের ও সমাজের হস্তক্ষেপে গোপন রাখা হয়, কখনো কখনো সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়। ধর্ষণকারীর সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ের মাধ্যমে মামলা থেকে ধর্ষণকারীকে রক্ষা করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করা হয়, এমনকি সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। যে কারণে মামলায় যেতে পরিবার বাধা দিয়ে থাকে। তা ছাড়া মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। মামলা গ্রহণে পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি, অদক্ষতা, অসততা, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক প্রভাব, সাক্ষীর সুরক্ষা না থাকা, ডাক্তারের দায়সারা গোছের রিপোর্ট ও আদালতে সাক্ষ্য প্রদানে অনীহা, ভিকটিম পরিবারের লোভ-লালসা, রাষ্ট্র পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবীর অসততা, অদক্ষতার সমন্বয়ে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ মামলায় আসামি শাস্তি পাচ্ছে, অন্যরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোয়ার বাইরে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের কারণে অভিভাবকরা কখনো কখনো কন্যাকে বাল্যবিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। যা কোনো সভ্য সমাজের চিত্র হতে পারে না।
হয়তো মানুষ হিসেবে কেউই সম্পূর্ণ স্বচ্ছ নই। কিন্তু স্বচ্ছতার, সততার চর্চা তো সবাই করতে পারি। কারো মানবিক অধিকার বঞ্চিত করে তার প্রতি অমানবিক নিপীড়ন করা হোক তা কোনোভাবেই কাম্য নয়- সবার দৃঢ়কণ্ঠে এর প্রতিবাদ উচ্চারিত হোক। আমাদের কন্যাশিশুদের জন্য একটা নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলি।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *