নারীর সৌন্দর্য্যের রকমফের

সৌন্দর্য্য একটি আপেক্ষিক বিষয়। একেক জনের কাছে এর মানদন্ড একেক রকম। আপনি বিশ্বের একটি অঞ্চলে সুন্দরী বলে প্রমাণিত হলেও অন্য অঞ্চলে আপনাকে কুৎসিত বলেই ধরা হবে। কারণ বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের সৌন্দর্যের ধারণা বিভিন্ন ধরনের। ফর্সা রংকে এশিয়ার কিছু দেশে সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হলেও ইউরোপ ও আমেরিকায় তার বিপরীত ধারণাই প্রচলিত।
কোরিয়ানরা সৌন্দর্যের বিষয়টিকে পশ্চিমাদের থেকে একটু ভিন্নভাবে দেখে। তাদের সৌন্দর্য ধারণায় রয়েছে ট্যান বা তামাটে বর্ণকে অপছন্দ করা। সেখানে তামাটে বর্ণ মানে আপনি কিছুটা গরিব এবং আপনাকে শ্রম ব্যবহার করে চলতে হয়। আর অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ফর্সারা ধনী এবং বিলাসী বলে ধারণা করা হয়। চোখ ছোট হওয়া কোরিয়ানদের অপছন্দ। আর এ কারণে প্রচুর কোরিয়ান চোখের পাতায় প্লাস্টিক সার্জারি করে। যাদের প্লাস্টিক সার্জারির সক্ষমতা নেই তারা ডবল আইলিড টেপ ব্যবহার করে। কোরিয়ানদের ‘ভি-লাইন’ ফেস প্রিয়। অনেকেই এটি সার্জারি করে তৈরি করে। বড় মুখের তুলনায় ছোট মুখ কোরিয়ায় জনপ্রিয়। এছাড়া রয়েছে লম্বা পায়ের জনপ্রিয়তা।
ভারতীয়দের মাঝে সৌন্দর্যের নিজস্ব নির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকলেও তা আশপাশের এশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গেও অনেকাংশে মিলে যায়। লম্বা উজ্জ্বল চুল ভারতীয়দের খুবই পছন্দ। তারা চুলের পরিচর্যায় নানা প্রসাধনী ব্যবহার করে। হরেক রকমের চুলের প্রসাধনী এখানে প্রচলিত রয়েছে। ফর্সা রঙ ভারতীয়দের মাঝে জনপ্রিয়। এজন্য প্রয়োজনে তারা ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করে। ফর্সা রঙ মানেই সুন্দর এই মানসিকতা সেখানে কাজ করে। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে ভারতে ফর্সা ব্রিটিশদের জয়জয়কার ছিল। আর সে সময়েই হয়ত এই মানসিকতার সূত্রপাত।
সারা বিশ্ব থেকে মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে জড়ো হওয়ায় এখানকার সংস্কৃতিও অনেকটা বৈশ্বিক।  শারীরিক মাপ যুক্তরাষ্ট্রের সৌন্দর্যের সংজ্ঞার অন্যতম বিষয়। প্লাস্টিক সার্জারি যুক্তরাষ্ট্রে বহুল প্রচলিত একটি চর্চা। নিজের দেহ পছন্দ না হলে অনেকেই সার্জনের ছুরির নিচে অনেকে  নিজেকে সোপর্দ করে। বহু সেলিব্রিটিই জীবনে অসংখ্যবার প্লাস্টিক সার্জারির দ্বারস্থ হয়। শুধু ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ১৫.৬ মিলিয়ন কসমেটিক সার্জারি করা হয়।
যুক্তরাজ্য রাজা-রানি শাসিত। আর এ দেশটিতে তারাই ফ্যাশন আইকন। কেট মিডলটনকেই সৌন্দর্যের অন্যতম রূপ বলে মনে করেন অনেক ব্রিটিশ নাগরিক। যুক্তরাজ্যে মেকআপ খুবই জনপ্রিয়। নারীরা একটি বড় সময় ব্যয় করে মেকআপে। এছাড়া দাগহীন ও সামান্য তামাটে ত্বক যুক্তরাজ্যে জনপ্রিয়।
আরব এলাকারও রয়েছে বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যের সংজ্ঞা। চোখের সৌন্দর্য আরবদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহু আরবই তাদের দেহ ঢেকে রাখে এবং মুখ বা চোখ অনাবৃত থাকে। তাই দেহের সৌন্দর্যকে চোখের মাধ্যমেই প্রকাশ করতে তারা উদ্যোগ নেয়।
ব্রাজিলে প্রতিদিন ১২০০ টির মতো প্লাস্টিক সার্জারি হয়, দেশটিতে গত শতকের শুরু থেকেই ‘সৌন্দর্য’-এর পেছনে বেশ বিনিয়োগ শুরু হয়। এই বিনিয়োগের একটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো পুরুষদের সন্তুষ্ট করা। অনেকে আবার বিখ্যাত মডেল হবারও স্বপ্ন দেখে। এসবের বাইরে কারও কারও জন্য সেটি আবার দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাবার একটি কৌশলও।
শুধু ব্রাজিল নয়, পুরো দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকায় এই ধরনের প্রবণতা বিদ্যমান। তবে ইউরোপ সেদিক থেকে বেশ আলাদা। সেখানে একজন নারীর সম্মান বা মর্যাদা নির্ভর করে তার উদ্ভাবনী শক্তি, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদির ওপর। যেমন জার্মানিতে কোন নারী যদি তার শরীরের ‘সৌন্দর্য’-এর প্রতি বেশি মনোযোগী হয়, তাহলে বিষয়টিকে খারাপ ভাবে দেখা হয়। মনে করা হয় সে তার নিজ কাজের প্রতি যত্নশীল নয়। শরীরের ‘সৌন্দর্য’-এর চাইতে পড়াশুনা বা কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়াকে সেখানে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
শারীরিক সৌন্দর্যকে বাংলাদেশেও গুরুত্বপূ্র্ণ মনে করা হয়। প্রসাধন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন বাংলাদেশে দর্শকদের অনেক ক্ষেত্রেই শেখায় এটি শুধু মেয়েদের ব্যবহার্য জিনিস যেটি কিনা তাদের ‘সুন্দর’ করে। রাজধানীসহ দেশের নানান জায়গায় দ্রুত বর্ধনশীল বিউটি পার্লারের দোকান এরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে একজন মেয়ের জীবনে ‘সৌন্দর্য’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনে যত নারী মডেল দেখানো হয় তাদের প্রায় সবাই ‘সুন্দর’। তাই কোন মেয়ে যদি মডেল হতে চায়, তাহলে তাকেও ‘সুন্দর’ হতে হবে, এমনকি তাকে তার ‘ফিগার’ সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে।
সুন্দরী হলে ‘ভালো’ জামাই পাওয়া যায় এ কথাটি সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা এক ধরনের শিল্প। এটি কারও কারও যোগ্যতা।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে একজন মেয়ের ‘সৌন্দর্য’কে তার শরীরের সঙ্গে এক করে দেখার প্রবণতা কমেনি বরং বেড়েছে। সেটি এরকম ধারণারই পুনরুৎপাদন করছে মেয়েরা ‘ভোগের বস্তু’। পরিহাস হচ্ছে নারী শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও এ ধারণা খুব বেশি বদলাচ্ছে না।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যের কারণে একজন মেয়ে কখনোই চায় না কেউ তাকে ‘অসুন্দর’ বলুক। সেটি কোন ছেলেও চায় না তবে তার মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক বেশ কম। সবারই ধারণা সুন্দর হতেই হবে তাই কি করলে সুন্দর দেখাবে এই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সমগ্র বিশ্বের নারীরা ।
একজন নারীকে যদি প্রথমেই তার শরীর ও সৌন্দর্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়, তাহলে সে নারীর জন্যও এ ধরনের বিবেচনা অপমানজনক। এটি নারী ও পুরুষ দু পক্ষকেই বুঝতে হবে।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *