বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ সবসময়েই কম দেখা গেছে। তবে আশার কথা এই যে, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান দিন দিন বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি সমান তালেই আজকের নারী ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে, নানা প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিচ্ছে। নারীরা এখন আর শুধু চার দেয়ালেই বন্দি নেই। তারা আজ শুধু চাকরি নির্ভর নয় বরং উদ্যোগী হচ্ছে নানা স্বাধীন ব্যবসায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যে। ফলে দিন দিন নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঠিক যেমনটি বলেছেন। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা যেখানে নারী সেখানে নারীকে বাদ দিয়ে এই দেশের কিংবা পৃথিবীর সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। নারীদের ক্ষমতায়ন ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য তাই এখন বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি নারীদের ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। এ কারণে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। ভবিষ্যতে সরকারের এসব সুযোগ সুবিধা অব্যহত থাকলে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়।আজকের দিনে একজন নারী নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
সামাজিক, পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অনলাইন উদ্যোগে নারীদের আজ স্বচ্ছন্দ পদচারণা। তারা
অনলাইনভিত্তিক উদ্যোগে বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য ও প্রসাধনী ইত্যাদি সেবা নিয়ে জনগনের মাঝে হাজির হচ্ছেন। তাদের এই প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগ ও সাফল্য চোখে পড়ার মতো। এই মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক বেশি উপস্থিতি লক্ষণীয় কেননা এভাবে তারা ঘরে বসেই তাদের পন্যসেবা পৌছে দিতে পারছেন মানুষের দ্বোরগোড়ায়।
তবে নারীদের এই এগিয়ে যাওয়া বা সাফল্যগাথার পাশাপাশি তাদের সম্মুখ পথে রয়েছে নানান বাধা বিপত্তি। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান বাধা হিসেবে যেটি বিবেচনা করা হয় তা হলো আমাদের সংস্কৃতি। যেখানে আমরা নারীকে একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায়, একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে দেখতে অভ্যস্ত। তবে আজ সময় পাল্টেছে আর বাস্তবতাও এখন ভিন্ন। ৩০ বছর আগের বাংলাদেশের অর্থনীতি আর আজকের অর্থনীতির হিসাব ভিন্ন। এখন পারিবারিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে সঙ্গে একজন নারী তার নিজস্ব সত্তাকে এই সমাজে সফলভাবে পরিচিত করে তুলতে সক্ষম। নারীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পথে সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা বাধাবিপত্তি ছাড়াও একটা প্রধান বাধা হচ্ছে নারীদের ঋণ লাভের যথেষ্ট সুযোগ নেই। ব্যাংক থেকে ঋন পাওয়ার ক্ষেত্রে জামানতের প্রয়োজন হয়। আর এই জামানত দেয়ার মত স্থাবর সম্পত্তি নারীর নামে থাকে না। পারিবারিক সম্পত্তিতে নারীরা চাইলেই পুরুষের মত তাদের প্রাপ্য চেয়ে বসতে পারেনা। যে কারনে একজন নারীর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকার পরেও ঋন গ্রহনে ব্যর্থ হয়। সামাজিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেকটাই বঞ্চিত। এর কারণ প্রথমত, শিক্ষার অভাব ও চলাফেরায় সামাজিক বাধানিষেধ। অধিকাংশ নারীই নিজেদের ক্ষমতা ও ব্যবসায়িক সুযোগের সদ্ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন নন। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সকল যোগ্যতা থাকলেও নারীরা প্রায়শই ব্যবসায়িক উদ্যোগে ঝুঁকি নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না, বা পুঁজির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তৃতীয়ত, এমন কিছু আইনগত বাধা ও সামাজিক রীতিনীতি রয়েছে যেগুলি শিল্প ও ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায়। যেমন- নারীরা যদি ঋণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির কাছে আবেদন করে সেক্ষেত্রে শর্ত হলো, তাদের অন্তত একজন পুরুষ অংশীদার থাকতে হবে। ফলে, নারী উদ্যোক্তারা যদি অপেক্ষাকৃত বড় কোনো ব্যবসায়িক কর্মকান্ড শুরু করতে চায় তাহলে তাদের কোন পুরুষের সঙ্গে যৌথভাবে তা করতে হয়। এছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লাভের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন শর্তাদি নারীদের সামর্থ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যার পিছনে কাজ করে পুরাতন ধ্যানধারণা ও মানসিকতা। নারী উদ্যোক্তাদের সামনে আরও কিছু বিশেষ ধরনের সমস্যাও রয়েছে। পুরুষেরা নারী উদ্যোক্তাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চায় না। পুরুষ উদ্যোক্তাদের প্রাধান্যে পরিচালিত বাজারে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন। চলাফেরার ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণেও নারী উদ্যোক্তারা অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে ব্যবসায়িক আলোচনা বা দরকষাকষিতে যেতে আগ্রহী হয় না। এতে করে সম্ভাবনা থাকলেও সব সুযোগ গ্রহণ করতে না পারায় অনেক সময় পিছিয়ে আসে নারীরা।