নারী যখন সাইবার হামলার স্বীকার হয়

প্রযুক্তির কল্যানে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার বাড়লেও সেইঅর্থে বাড়েনি জনসচেতনতা। প্রযুক্তির সুফলের পাশাপাশি বেশকিছু কুফলও তাই লক্ষনীয় আজকের সমাজে। যেহেতু এখনকার দিনে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত সহজলভ্য একারণে দেশে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার যত বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। তবে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এর প্রতিকার এবং অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোয় এই অপরাধের প্রবণতা বেশি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা বেশিরভাগক্ষেত্রে এই সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেন এবং কিভাবে আর এই অবস্থা নিরসনে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। সাইবার অপরাধ এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন দেশের সাইবার অপরাধ নিয়ে একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের সূত্রমতে, শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে৷ আর এই অভিযোগের একটি বড় অংশের অভিযোগই ফেসবুক সংক্রান্ত৷ যার মধ্যে রয়েছে আইডি হ্যাক থেকে শুরু করে সুপার ইম্পোজ ছবি এবং পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগও। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরাই সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে সাইবার অপরাধের। শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৭৪ শতাংশ। নারীরাই বেশি সাইবার হামলার শিকার হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জানেনা কীভাবে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া যায় আর প্রায় ২৫ শতাংশ নারীরা মনে করে অভিযোগ করে লাভ হবেনা বা অভিযুক্তরা শাস্তি পাবেনা। এক্ষেত্রে প্রতিকারের উপায় নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার অভাব এবং লোকলজ্জা ও ভয়-ভীতিকে প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন নারীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, তেমনি ব্ল্যাক-মেইল ও হুমকির কারণে তাদের ব্যক্তিগত জীবনও দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে৷ শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে এইধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আর তাই প্রতিকার চাওয়া বা পাওয়া মানুষের সংখ্যাও খুবই কম।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক কাজী মুস্তাফিজ মনে করেন তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের অজ্ঞতার কারণে দিনকে দিন এ ধরণের অপরাধ বেড়েই চলছে। তার মতে, “সহজে হাতের কাছে ইন্টারনেট পাওয়ার কারণে ইন্টারনেটের অপব্যবহার বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার হামলায় শিকার হন। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র ওষুধ হলো সচেতনতা বাড়ানো। প্রযুক্তির সুবিধাগুলো ভোগ করার পাশাপাশি এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।”
বিশ্বায়নের এই যুগে দৈনন্দিন জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহারকে এড়ানো সম্ভব নয়। তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা রাখা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মিডিয়ারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন যাতে করে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ধরণের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধের ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বাড়ানো গেলে এ ধরণের অপরাধ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
সাইবার অপরাধের প্রতিকারে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ২০০৬ সালে প্রথম সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৩ সালে এই আইন সংশোধন করা হয়। ঐবছরই দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনাল ঢাকায় স্থাপন করা হয়। উল্লেখিত আইনে কারো অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও তোলা এবং তা প্রকাশ করার অপরাধে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আইন প্রনয়নের পাশাপাশি সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ করা হলে সাইবার অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।  বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে একটি সাইবার হেল্প ডেস্কও রয়েছে৷ দেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ হেল্পলাইনে সরাসরি ফোন করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন। এর পাশাপাশি সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে হটলাইন ‘৯৯৯’ চালু করেছে সরকার। যে কেউ সাইবার অপরাধের শিকার হলে এই হটলাইনে ফোন করেও অভিযোগ জানাতে পারবেন। সাইবার অপরাধ ঠেকানোর মূল ওষুধ সচেতনতা বাড়ানো। সচেতনতা যত বাড়বে অপরাধ ততই কমবে।
অনলাইন ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক হতে হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আইটি বিশেষজ্ঞরা৷ সকলেরই উচিত নিজের ফেসবুক, ইমেইল আইডি সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলানো এবং এ ধরণের তথ্য কারও সাথে শেয়ার না করা।
সাইবার অপরাধ ঠেকাতে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর কারণ হলো ২০১৩ সালে আইসিটি আইন সংশোধন করা হলেও এই আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্ক থেকে গেছে৷ এই ৫৭ ধারায় এমন সব ইস্যু যুক্ত করা হয়েছে যার কোন পরিষ্কার ব্যাখ্যা আইনে নেই৷ ফলে আইনটি ইচ্ছেমত ব্যবহারের সুযোগ থেকে যায়। এছাড়াও থানায় মামলা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাইবার অপরাধ বিষয়ে তেমন একটা দক্ষতা নেই। একারণে প্রযুক্তিতে দক্ষ অপরাধীদের মোকাবিলায় পুলিশ কতটা প্রস্তুত সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। দক্ষতার অভাবে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো তদন্তে হিমশিম খেতে হয়। একারণে  তদন্তে কালক্ষেপণ হয়ে থাকে। আর যখন কোন অভিযোগ করা হয় সেই তদন্ত করার সময়ের মধ্যেই বিতর্কিত পোস্টটি হয়তো ভাইরাল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রিপোর্ট করেও কোন কাজ হয় না যারফলে অভিযোগকারী নারীকে বিপাকে পরতে হয় আরও একটি কারণ হলো গুগলে স্থায়ীভাবে সেগুলো থেকে যাওয়ায় সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন ভুক্তভুগী নারীরা।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *