নারীবাদের মূল উপজীব্য

নারীবাদ আসলে কি বা এর ধরণ ও প্রকৃতি এবং নারীবাদী আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। এরপর একেকজন বিষয়টিকে একেকভাবে দেখেন। সামগ্রিক স্বার্থের চেয়ে এখন ব্যক্তিগত স্বার্থে নারীবাদী আন্দোলনকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সময় এসেছে আমাদের নারীবাদীদের মনের ভাব ও কাজের প্রকৃতি পরীক্ষা করে দেখার।
এই শতাব্দীর নারীবাদ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। যেমন-
১. নারীবাদীদের কাজ কি কোন নির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক নারীদের অধিকারের জন্য কাজ করা?
২. নারীবাদ কি সমগ্র নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করবে বা তাদের কর্তব্যের বিষয়ে গুরুত্ব দিবে কিনা?
৩. নারীবাদী মনোভাব পোষণ করার জন্য কতটুকু শিক্ষা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হবে? নাকি অবান্তর কথা বলে পরিচিত হওয়াই নারীবাদ?
৪. নারীবাদ না মানবতাবাদ- কোনটি অধিক প্রয়োজন? বিশেষ করে বর্তমান পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে নারীবাদ ধারণা (তত্ত্ব) নারীদেরকে কি নারী হিসেবেই রেখে দিচ্ছে না?
উপরের চারটি প্রশ্নেরই ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের দেশীয় (পরিচিত) নারীবাদীদের কর্মকান্ডে তীব্র রাজনৈতিক অন্ধত্ব প্রকাশ পেয়েছে। নারীবাদী কর্মকান্ডে রাজনীতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয় মূলত- বড় দুই দলের নারীবাদীদের কর্মকান্ডে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে মাসুদা ভাট্টিকে চরিত্রহীন বলাতে নির্দিষ্ট একটি দলের সমর্থক নারীবাদীরা মাঠ সরগরম করে ফেলল অথচ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেয়েদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় তারাই কিন্তু নীরব ছিল। আবার অপর রাজনৈতিক দলের নারীবাদীদের অবস্থাও একই। তারা আবার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেও মাসুদা ভাট্টির ঘটনায় তারা ছিল নীরব দর্শক। এই পক্ষপাতিত্বের বিষয়টি অত্যন্ত ভয়ংকর এবং উদ্বেগজনক একই সাথে। নারীবাদীদের প্রতিবাদ কেন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হবে? ভিন্ন মতাদর্শের নারীর অধিকার কেন ক্ষুন্ন করা হবে বা হলে তার প্রতিবাদ কেন করা হবে না এ প্রশ্নটি থেকেই যায়। আর যারা এমন দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী তাদের তো আদতে কোন যোগ্যতা নেই নারীবাদী পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার। এটা কেবলই তাদের কাছে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থের মুখোশ মাত্র।
রাষ্ট্র, সমাজ এবং পরিবার- সবখানেই দুইটি নিয়ম মেনে চলতে হয় মানুষের। অর্থাৎ একটি হচ্ছে অধিকার অন্যটি হচ্ছে কর্তব্য। নারীদের অধিকারের জন্য যারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে “সম-অধিকার” বুলি কপচাতে থাকে তারা সেভাবে কিংবা তার সিকিভাগও কর্তব্য পালনের বিষয়ে জোর দেয় না। অথচ এই সমাজের একজন মানুষ হয়ে হিসেবে আমরা যদি নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন থাকি তাহলে এর সাথে সাথে আমরা এই সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকেও এড়িয়ে যেতে পারিনা।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অধিকার এখনো সবক্ষেত্রে সমানভাবে নিশ্চিত হয়নি একারণে নারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠন থাকবে এটা একটা সাধারণ ও স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু তাইবলে অবান্তর কথা, দাবি ও হাস্যকর কর্মকান্ডের মাধ্যমে কতিপয় নারীবাদীরা (?) নারীবাদ বিষয়টিকে হাস্যকর ও সংকীর্ণ করে তুলে ধরতে পারেন না।নারীবাদীদের জন্য শিক্ষা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার একটা সুস্পষ্ট মানদন্ডের প্রয়োজন। এবং এই বিষয়টি নারীবাদ তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে এই স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে নারী ও পুরুষকে কিছু সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই নারী ও পুরুষের পোশাক আলাদা রকম। এখন যদি কারো নারীবাদী মন জাগ্রত হয়ে এই বিষয়টিকে পুরুষের দ্বারা চাপানো নিয়ম বলে উল্লেখ করে তখন বিষয়টি নিছক কমেডি ছাড়া আর কিছুই হয় না। এজন্যই নারীবাদীদের জন্য সুনির্দিষ্ট শিক্ষা প্রয়োজন। নারীবাদী আলোচনা হতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক। যেমন – প্রশ্ন যদি তুলতেই হয় তাহলে তারা এই প্রশ্ন তুলতে পারে যে, মেয়েরা খেলতে নামলে “বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল” কিংবা “বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল” বলা হয় অথচ পুরুষ দল নামলে “টিম বাংলাদেশ” বলা হয় কেন? এখন থেকে “বাংলাদেশ পুরুষ ক্রিকেট দল” বা “বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল” বলতে হবে। এই দাবি কাউকে তুলতে দেখা যায়না আর এখানেই তাদের জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
শেষ প্রশ্নটি ছিল নারীবাদ না মানবতাবাদ- কোনটি প্রয়োজন? নারীবাদ বাদ দিয়ে যদি মানবতাবাদ নিয়ে কাজ করা তবে নারীদের সমস্যারও সমাধান হয়ে যেত। অথচ নারীবাদীদের মনে সব সময় পুরুষের বিরোধিতা করার একটা প্রবণতা ঘুরপাক খেতেই থাকে। কিন্ত আসলে নারীবাদী মানেই তো আর পুরুষবিদ্বেষী হওয়া নয়। কারণে অকারণে পুরুষের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করাই অনেকের কাছে নারীবাদ।
নারীবাদ কারো ব্যক্তিগত পরিচিতির প্লাটফর্ম হতে পারেনা। ক্ষুদ্র এবং ব্যক্তিগত চিন্তার বাইরে গিয়ে বৃহৎ এবং সামগ্রিক বিষয়কে নিয়ে ভাবতে হবে। চিন্তার প্লাটফর্ম হোক মানবতাবাদ। জয় হোক মানবতাবাদের। আমরাও হয়ে উঠি মানবতাবাদী।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *