নারীদের যখন পণ্য করা হয় ব্যবসায়

মানুষের কাছে খুব সহজে ছোট পরিসরে বড় ধরণের একটি বার্তা পৌছে দেবার কিংবা সচেতন করার অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে বিজ্ঞাপনের কোন জুড়ি নেই। এর মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করা বা তাদের কাছে পৌছানো যায়। যত দ্রুত মানুষের কাছে পৌছানো যাবে ব্যবসার জন্য ততই মঙ্গল। একারণে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনেক সময় জনগনকে বোকা বানানো হয়।  “প্রচারেই প্রসার” কথাটিকে ব্যবসায়ীরা এখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে আত্মীভূত করে ফেলেছেন। ব্যবসার স্বার্থে তথা পুঁজির বিকাশে প্রচার মাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। চটকদার বিজ্ঞাপন সহজেই মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম। যেমন – কোন ঢেউটিন কিনলে একজন মানুষ আজীবনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারেন, কোন সাবান কিনলে জীবাণুর কোন ভয় থাকে না, কোন গুড়োদুধ খেলে বুদ্ধির বিকাশ হয় আবার কোন ক্রিম মাখলে সহজেই ফরসা হওয়া যায় এসবকিছুই আমাদের ইনফ্লুয়েন্স করে আজকাল। আর বিজ্ঞাপনের  পাত্র-পাত্রীদের দিয়ে নির্মাতা কোন ধরণের বার্তা আমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছেন কিংবা তার পাঠানো বার্তাটি আদৌ সমাজের জন্য কোন ভালো পরামর্শ বয়ে আনছে কি না বা কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কিনা সেটিও কিন্ত একটি দেখবার বিষয়।
বিজ্ঞাপনের মত প্রচারমাধ্যম আজ একটি কলারূপে আবির্ভূত। তবে সমস্যাটা অন্যখানে আর তা হলো, এ কলা যেন নারীকে অধঃস্তন করে রাখতেই ব্যতিব্যস্ত। পুরুষকে আকর্ষণ করার জন্য বিজ্ঞাপনে নারীকে হাজির করা হয় যৌনতার প্রতিবিম্ব হিসেবে, যেনো নারীর প্রথম কাজই হলো পুরুষকে আকর্ষণ করা, যেনো পুরুষের সন্তুষ্টি অর্জন করাই নারীর শেষ ভরসা। কখনোবা স্নেহময়ী মা, আদুরে স্ত্রী, ভদ্র ঘরের শান্ত মেয়ে হিসেবেই আবির্ভূত হন নারীরা। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় নারী প্রানপণ দিয়ে কাপড় ধুয়ে যাচ্ছে তবু দিন শেষে সেই কাপড় স্বামীর মন মতো না হওয়ায় তাকে কটু কথা শুনতে হচ্ছে। আবার দেখা যায় স্ত্রী বাসায় না থাকায় স্বামী এবং সন্তানরা মহা মুশকিলে পরেছে। কখনো বাসায় খাওয়ার কিছু নেই কখনোবা বাড়িতে একগাদা নোংরা কাপড় জমেছে। যা ধোয়ার কেউ নেই। এখন কথা হচ্ছে বাড়ির সমস্ত কাজের দায়ভার একজন নারীকেই কেন নিতে হবে? সে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজন কিংবা এম্নিতেই একদিন নিজের ইচ্ছায় বাড়ি থেকে বাইরে থাকতে পারবে না? এ কেমন ম্যাসেজ হলো সমাজের প্রতি? আবার রঙ ফরসাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর বোন বা বান্ধবীকে পছন্দ করেছে শুধুমাত্র গায়ের রঙের জন্য। এছাড়াও চাকরির ইন্টারভিউতে নাকি গায়ের রঙ কনফিডেন্স বাড়ায়। গুড়ামসলার বিজ্ঞাপনে নারীকে গৃহিনী হয়ে থাকার ট্রেনিং কিংবা পরামর্শ দেয়া হয়।  Stereotype নারীকে প্রসাধন প্রিয়, দুর্বল, নির্বোধ, যৌনবস্তু, পুরুষ নির্ভর সত্তা, সংসারসেবী, কলহপ্রিয় ও গৃহকমী হিসেবে দেখানো হয়। মানে সব বিজ্ঞাপনেই নারীদের ঐ পণ্যটির মতই উপস্থাপন করা হয়ে থাকে, যে পণ্যটির বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে। আবার পুরুষদের পোর্ট্রেয়াল দেখলেও চমকে উঠতে হয়। নারী শুধু ভোগ্য আর পুরুষ হলো ভোক্তা এ মতবাদই প্রচারে ব্যস্ত মিডিয়া কিংবা সংশ্লিষ্টরা।
মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ফিলিপ কোটলার মতে, “বিজ্ঞাপন হলো অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট উদ্যোক্তা কর্তৃক কোন পণ্য, সেবা বা ধারণার যেকোন অ-ব্যক্তিক প্রচারণা।” আমাদের আজকের ভোগবাদী সমাজের এই বিজ্ঞাপনগুলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো এরা অনেক বেশি মাত্রায় জেন্ডার বৈষম্যপূর্ণ। এখানে নারীকে উপস্থাপন করা হয়- কলহপ্রিয়, শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল, পুরুষ সংসারসেবী প্রভৃতি বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে। টেলিভিশন, বিলবোর্ড, রেডিও এমনকি সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে নারীকে উপস্থাপন করা হয় সামাজিকভাবে ছাঁচিকৃত ধারণার ভিত্তিতে। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চেতনা যেন দাসত্ববরণ করছে ধীরে ধীরে।
মিডিয়ার শক্তিশালী ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের প্রসারে পুরুষের মালিকানাধীন মিডিয়া নারীকেই পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে বরাবরই। মিডিয়া নারীর উন্নয়নের কথা বলছে আবার পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে এই নারীকেই। এছাড়াও প্রচার মাধ্যমগুলোতে নারীকে সবসময় পুরুষের অধস্তন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞাপন চিত্রে অহেতুক নারীর উপস্থিতি টেনে আনা হয়। চলচ্চিত্র কিংবা নাটকে নারীকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন শাড়ি কিংবা গয়না ছাড়া নারীদের আর কিছুই চাইবার নেই। গণমাধ্যমে নারীকে হীনভাবে উপস্থাপন করার জন্যে নারীরাও অনেকাংশে দায়ী। কেননা তারা নিজেরাও সচেতন নয় এই ব্যাপারে যে কোন কাজগুলো তাদের করা উচিৎ এবং কোনগুলো উচিৎ নয়।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *