ফেনীর সোনাগাজির মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। এ যেনো এক প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। নুসরাত তারই প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে যে প্রতিবাদের ধারা শুরু করেছিলো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সময় পর্যন্ত সে ধারাতেই নুসরাত দৃঢ় ছিলো। শেষ নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত সে বলে গেছে, ‘প্রতিবাদ করেই যাবে’। তার প্রতিবাদের ধারাতেই দেশজুড়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল আপামর জনতা। নুসরাত মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করায় অধ্যক্ষ তার অনুসারীদের কে হত্যার প্ররোচণা দিয়ে নির্দেশনা প্রদান করে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া এক হত্যাকারী স্বীকার করে যে এর আগে নুসরাত কে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে সে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং পূর্ব রাগের জের ধরে সেও এই হত্যা পরিকল্পনায় অংশ নেয়।
হত্যা পরিকল্পনাকারীরা এর আগে ২০১৬ সালে নুসরাতের চোখে চুন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ছুঁড়ে মেরেছিল। তখন নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যক্ষ এর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করে নিহত নুসরাতের পরিবার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এই ঘটনারই জের ধরে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার নির্দেশে ৬ই এপ্রিল মাদ্রাসার ভেতরের পরীক্ষার হল থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে গিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন। নুসরাত তারই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেই আসামীদের চক্ষুশূল হয়েছিলো। হত্যাকান্ডের মামলায় পিবিআই দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাতের মায়ের করা মামলার পর থেকেই ক্ষিপ্ত হন আসামীরা। অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর আসামীদের কয়েকজন কারাগারে তার সঙ্গে দুই দফা দেখা করতে গিয়ে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা পেয়েই মাঠে নামেন। আর এই পরিকল্পনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগতরা, যাদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন ছাত্র, অধ্যক্ষের আত্মীয় এমনকি নুসরাতের সহপাঠীও ছিলো।
দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনা তদন্তের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনা উদঘাটন করেছেন তারা। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই বলেছে এ ঘটনার কারণ হলো -“আলেমদের অপমান আর প্রেমের ব্যর্থতা”। “কিন্তু তদন্তে আমরা সেটি পাইনি। আমরা যা পেয়েছি তা হলো ওই মাদ্রাসার সকলের স্বার্থে মেয়েটি ঘাঁ দিয়েছিলো।”
দেহের ৮০ শতাংশজুড়ে আগুনের ক্ষত নিয়ে নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সেই নির্যাতনের বিভৎস ঘটনা বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে। যৌন নিপীড়কের জন্য একটি আতঙ্কের নাম হয়ে থাকবে মৃত্যুঞ্জয়ী নুসরাত। নুসরাতের প্রত্যয় ছিল সে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়বে এবং অভিযুক্তদের এমন শাস্তি দেবে যা দেখে অন্যরা শিক্ষা নেবে।
আদালত নুসরাতকে দিয়েছে বিশেষ চরিত্রের অধিকারী নারীর খেতাব। অপরদিকে মামলার প্রধান আসামী দুশ্চরিত্র অধ্যক্ষ সিরাজসহ আসামীদের ‘কালিমা লিপ্তকারী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।