আমাদের দেশে ও বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদেরকে পুরুষের সেবাদাসী করে রাখা হয়েছে। চার দেয়ালের ভেতর বন্দি হয়ে থাকাই নারীদের ভাগ্য এসব দেশে। আবার নারীরা অনেক সময় নিজেদেরকেও আটকে রেখেছিল, শুধুমাত্র এ পুরুষ সমাজে টিকে থাকার জন্য। আবার এদিকে পুরুষরাও নারীদেরকে নিজেদের সেবিকা হিসেবেই ভেবেছে এবং দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, নারীরা নিজেদেরকেও সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নির্ভরশীল হওয়া কিংবা সকল কাজে পুরুষের সমকক্ষে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো তারা অসম্ভব মনে করতেন এবং দুর্ভাগ্যবশত এখনও অনেকেই এমনটাই ভাবেন। সবাই ধরেই নেয় যে নারীরা চার দেয়ালের ভেতরেই নিজের জীবনটাকে আটকে রাখবে। এই পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজে নারীরা একজন পুরুষের উপরই নির্ভরশীল হয়ে থাকবেন এবং তাদের জন্য গৃহস্থ করবেন ও রান্না করবেন এবং পুরুষদের শারীরিক আনন্দ যোগাবেন, এইতো নারীর জীবন। আর এই দঙ্গল থেকে বের হতে চাইলে একজন নারীকে খারাপ ও নিকৃষ্ট হিসেবে দেখা হয়!
যেকোনো কাজ কে কি লিঙ্গ দিয়ে বিভক্ত করা যায়? নাহ কাজের কোনো লিঙ্গ নেই। যা মানুষের কাজ তা মানুষই করবে। সেই মানুষ নারীও হতে পারে আবারও পুরুষও হতে পারে। একজন মানুষ কারো অপকার নাহ করে যেভাবে জীবনে চলতে চায় চলতে পারে সেই অধিকার সে রাখে এবং সেখানে বাধা দেওয়ার অধিকার কেউ রাখে নাহ। সেটা জুলুম সেটা অবিচার। পুরুষ যদি নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে একজন নারীও পারে। পুরুষ যদি পারে মাঠে ফুটবল খেলতে তাহলে একজন নারীও মাঠে ফুটবল খেলার অধিকার রাখে। পুরুষ যদি বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে একজন নারীও বিমান চালানোর অধিকার রাখে। আবার, নারী যদি রান্নাবাড়া করতে পারে তাহলে পুরুষও রান্নাবাড়া করতে পারে। নারী যদি বাসনকোসন ধুতে পারে তাহলে পুরুষও তা করতে পারে। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ কি করবে আর কি করবে নাহ সেটা যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং অধিকার এটা অধিকাংশ মানুষ নাহ বুঝা পর্যন্ত আমরা এক অসভ্য জাতির উদাহরণ ছাড়া কিছুই নাহ!
পুরুষের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী সমাজে নারী মাত্রই কম বুদ্ধিসম্পন্ন নিচু জাতের এক প্রাণী। সে সারাদিন ঘরে থাকবে, রান্নাবাড়া করবে, স্বামীর দৈহিক চাহিদা মেটাবে এভাবেই নারীকে দেখে তারা স্বস্তি বোধ করে। পুরুষের বশ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে নারী স্বনির্ভর হবে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিবে, পুরুষের সহযাত্রী হবে, নেতৃত্ব দিবে তা সহ্য করতে পারে নাহ পুরুষের কর্তৃত্বে বিশ্বাসীরা! সেজন্য তারা চায় নাহ নারী বিমান চালাক, চায় নাহ নারী অফিস আদালতে যাক, চায় নাহ নারী নেতৃত্ব দিক, চায় নাহ মেয়েরা মাঠে ফুটবল খেলুক। নারী স্বাধীনতার প্রতি বিদ্বেষ থেকেই তারা দ্বিধাহীন ভাবে বিমান দূর্ঘটনার মতো ঘটনায় নারীকে সেই দূর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে দাবি করে। মেয়েরাও বিমান চালানোর মতো যেকোনো কঠিন কাজ অনায়াসে করতে পারে তা তারা মানতে রাজি নাহ! আচ্ছা সক্ষমতা বা দক্ষতা বা জ্ঞান বুদ্ধি এসব কি লিঙ্গভেদে কমবেশি হয়? মেয়ে হলে কম জ্ঞানী হবে বা ছেলে হলে বেশি জ্ঞানী হবে ব্যাপারটা কি এরকম? তাহলে তো সব পুরুষই কাজেকর্মে জ্ঞান বুদ্ধিতে যেকোনো নারীর চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা। বাস্তবে আমরা সেরকম দেখি নাহ কেন? লিঙ্গভেদে মানুষের বোধবুদ্ধি কম বেশি হয় বা নারীর জ্ঞান পুরুষের তুলনায় কম হয় ইত্যাদি বিকারগ্রস্ত মানুষের অদ্ভুত ধারনা ব্যতীত কোনো প্রমাণিত সত্য নয়! সক্ষমতা লিঙ্গভেদে আসে নাহ, তা অর্জন করে নিতে হয়।
সক্ষমতা যদি লিঙ্গভেদেই আসতো তাহলে আজকে ঘরে ঘরে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এবং পাইলট থাকার কথা। একজন পুরুষ ডাক্তার যদি রোগী বাঁচাতে ব্যর্থ হয় তাহলে দোষটা কি তার পুরুষ হওয়ায় হবে? যদি সেরকম নাহ হয় তাহলে কেন বিমান দূর্ঘটনার কারণ নারী হবে? তারা বলে, গাড়ি চালানো নারীর কাজ নাহ। নারী গাড়ি চালালে দূর্ঘটনা ঘটবে, বিপদ আসবে! তাহলে কি শত শত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটার কারণ ড্রাইভারের পুরুষ হওয়া? তারা বলে, দেশের নেতৃত্ব যদি একজন নারী দেয় তাহলে অশান্তি তো আসবেই! সত্যি কি তাই? তাহলে একজন পুরুষের নেতৃত্বে থাকা দেশেও কেন অশান্তি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে? সেসব দেশে অশান্তি বিরাজ করার কারণ কি সেসব দেশের প্রধান পুরুষ হওয়া? কারণ আর যাইহোক সবকিছুতে নারীকে দায়ী করা নারী বিদ্বেষ থেকেই আসে। নারী বশ্যতা মেনে পায়ের নিচে পড়ে থাকবে নাহ, এগিয়ে যাবে সেটা মূলত সহ্য হয় নাহ। সবকিছুতে প্রিথুলা রশিদদের সহজেই দায়ী করা যায়। মুখ থাকলে সহজেই বলা যায়, হাত থাকলে সহজেই লেখা যায়। কিন্তু ভয়ংকরতম মুহূর্তে নিজের জীবনের কথা নাহ ভেবে দশজনের জীবন বাঁচানোর মতো বীরত্বের কাজ সবাই করতে পারে নাহ। আমি নিশ্চিত যারা বিশ্বাস করে বিমান দূর্ঘটনার কারণ নারী পাইলট তারা কখনো পারবে নাহ এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রিথুলার মতো মহৎ কাজ করার! কারণ এতো নিচ মনোভাব নিয়ে নিজের জীবনের কথা নাহ ভেবে অন্যের জীবন বাঁচানো যায় নাহ। প্রিথুলা যা করেছে তা সেই বিকারগ্রস্তদের গালে থাপ্পড় হয়ে থাকবে সবসময়!
তাছাড়া কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইসলামি আন্দোলনের নেতাকর্মীদের গালেও এটি একটি থাপ্পড় হয়ে থাকবে। তারা নারীদের জীবনের বিরুদ্ধে, তাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যে মেয়েরা মাঠে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলতে যায় তারা কিন্তু নিজেদের কে ভোগ্যপণ্য মনে করে না। তারা নিজেদেরকে মানুষের মতই মর্যাদা দিয়ে নিজেদের জীবনটা নিজেদের মত করে বাঁচতে চাইছে। আর এদিকে উগ্র ইস্লামিন নেতাকর্মীরা তাদের ডানা কেটে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের মতে মেয়েরা ফুটবল খেললে তা বেহায়াপনা, কিন্তু একজন ছেলে তা করলে মোটেও বেহায়াপনা হয়না! তারা মনে করে শুধুমাত্র পুরুষদেরই স্বাভাবিক ও স্বাধীন ভাবে বেচে থাকার অধিকার আছে, নারীদের নেই। তাই তো তারা নারীদেরকে পুরুষদের বানানো নিয়মের গণ্ডির ভিতর রাখতে চায়, বের হতে দেয় না বা নানা ভাবে বাধ্য করে। তাদের এত আস্পর্ধা কিভাবে হয়? এতো সাহস তারা কিভাবে পায়? আমরা কি পারিনা তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বপ্ন পুরনে কাজ চালিয়ে যাওয়া? বন্দি চার দেয়ালের বাধন ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে কি আমাদের খুব কষ্ট হবে? এখনই সময় এসব নিয়ে চিন্তা করার এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচি হাতে নেয়ার।