বাংলা সাহিত্যে নারীদের ভূমিকা

অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাহিত্যও পুরুষ লেখকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। লেখকদের সর্বদাই একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। এ প্রথা সর্বকালের এবং সর্বযুগের। আবার কখনো নারী লেখকদের লেখাকে বিভিন্ন সাহিত্যে অবমূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সাহিত্যকে সাহিত্যের দৃষ্টিতেই মূল্যায়ন করা প্রয়োজন আর এখানে নারী কিংবা পুরুষ লেখক ভেদে মূল্যায়ন করা হলে সাহিত্য এবং সাহিত্যিকদের প্রতি অবিচার করা হয়। বাংলা সাহিত্যে নারী এবং তাদের অবস্থান ও অবদান নিয়ে আজকের এই লেখা।
বাংলা সাহিত্যে নারী-পুরুষের প্রভেদ এবং সমাজের সমালোচনা বিগত ২০০ বছর ধরেই চলছে। রাজা রামমোহন রায় ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ নারী- পুরুষের প্রভেদ কমানোর জন্য কাজ করেন। বাংলা সাহিত্যে নারীদের বিচরণ উলে­খযোগ্য ভাবে লক্ষ্য করা যায় ১৯ শতাব্দী থেকে এবং ২০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে নারী লেখক তাদের সমকালীন পুরুষ লেখকদের পেছনে ফেলে সাহিত্যে নিজেরদের অবস্থান তৈরী করেন নেন।
বিংশ শতাব্দীতে সাহিত্যে যারা বিশ্বের দরবারে নাম করেন তাদের মধ্যে প্রধান- আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬), নবনীতা দেব সেন (১৯৩৮) এবং মলি­কা সেনগুপ্ত প্রধান। মুসলিম লেখকদের মাঝে প্রধান বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং সুফিয়া কামাল। যদিও ১৯৫০ এর দশকে সাহিত্যে পুরুষের প্রাধান্য বেশি ছিল তবে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে কৃষ্ণা বসু এবং মল্লিকা সেনগুপ্ত ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা সে সময় সাহিত্যের জগতে একরকম ঝড় তুলেছিল বলা যেতে পারে। মল্লিকা সেন গুপ্তের কবিতা এখনো রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
মহাশ্বেতা দেবী হিন্দু ধর্মের নিম্ন জাত দলিতদের (যাদেরকে অছ্যুত বলে মনে করা হয়) অধিকার নিয়ে লেখালেখি করেন। তিনি অসম সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনা করেন। তবে দেবী নারীবাদিতার ব্যাপরে খুব বেশি উদার মনোভাব পোষণ করতেন না। মল্লিকা সেনগুপ্ত অন্যদিকে সম্পূর্ণভাব নারীবাদিতার পক্ষে ছিলেন। তার লেখা পাঠককে সমাজের বিভিন্ন দিকের দুর্বলতাকে বুঝতে সহযোগিতা করে।   এ দু’জন লেখক শুধু তাদের সময়কার আলোচিত নারীবাদী লেখক ছিলেন না, বর্তমানেও তারা বহুল পঠিত এবং অনেক সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত। তাদের লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।
অভিবক্ত বাংলার প্রথম মুসলিম বাঙালি নারী যিনি নারী ও পুরুষের সম অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তিনি হলেন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বাংলার নারীবাদী লেখকদের মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী লেখক বলে গৃহীত। তিনি রম্য, ব্যঙ্গ রচনার মাধ্যমে বাঙালি নারীর প্রতি অসমতার কথা উলে­খ করেন। সমাজের যে সব প্রথা নারীকে উন্নতির পথে বাধা প্রদান করে সে সব বিষয় তার লেখায় নিয়ে আসেন। তিনি সমাজের তথা-কথিত রীতি নীতির বিরুদ্ধে লেখেন। তিনি মূলত মুসলিম নারীর শিক্ষার বিষয় গুলো নিয়ে লেখা লেখি করেন। তিনি কখনই নারীদের প্রগতির জন্য কাজ করতে পারতেন না যদি না তার ভাই ও স্বামী তাকে পূর্ণ সমর্থন না করত।আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজে মেয়েদের চাল-চলনে সব-সময়ই বাধা প্রদান করা হয়।এখানে লোক লজ্জা ও লোকের ভয় অনেক বেশি।
স্বাধীনতার পর যে সব নারী সাহিত্যক বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে উলে­খযোগ্য ভুমিকা রেখেছেন তাদের মাঝে সেলিনা হোসেন(১৯৪৭) এবং রিজিয়া রহমান(১৯৩৯) অন্যতম প্রধান। স্বাধীনতার যুদ্ধের পরপর বলেই হয়ত মুলত তাদের উপন্যাসে যুদ্ধের কথা বেশ বড় আকারে প্রকাশ পায়।সেলিনা হোসেনের লেখা ‘গায়িত্রী সন্ধা’ ও রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’ অন্যতম প্রধান।
স্বাধীনতার পর নারীবাদী ও আপসহীন লেখিকা হিসেবে পরিচিত,আলোচিত ও সমালোচিত হন তসলিমা নাসরিন। তসলিমা নাসরিন নারী প্রগতিবাদী নন বরং কঠোর নারীবাদী যেখানে তিনি পুরষের প্রতি তার আক্রোশ পরিস্কার ভাবে তুলে ধরেছেন।তসলিমা নাসরিন ১৯৮২ এবং ১৯৮৩ সালে কবিতা লিখে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার কবিতা মূল বিষয় বস্তু ছিল নারীদের অসমতা।তসলিমা নাসরিন মূলত মানবধর্ম, চিন্তার স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং নারীদের সমান অধিকারের জন্য কাজ করেন। তসলিমা নাসরিনের পর বাংলা সাহিত্যে এত সমালোচিত কোনো লেখক হননি এবং নারীবাদী লেখকের জন্মও হয়নি। তবে তসলিমা নাসরিনের একটা প্রভাব রয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে। তসলিমা নাসরিনের এই বিতর্কের ফলে বাংলাদেশের অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের মেয়ে সন্তানদেরকে সাহিত্য চর্চায় অনুস্ত্সাহিত করছেন যা একটি দেশের সাহিত্য জগতের জন্য বেশ বড় ধরনের ক্ষতি।
তবে বাংলা সাহিত্যে নারী লেখক যারা এ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাপী নাম করেছেন তারা সকলেই নারীর অধিকার ও প্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন। এটাই ছিল মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে নারীদের ভুমিকা কম তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাংলায় সবসময়ই নারী শিক্ষার হার কম। দুএখনও প্রায় অর্ধকেরও বেশি নারী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যেখানে শিক্ষা নেই সেখানে সাহিত্য হয় না।   সাহিত্যে সেদিন অবশ্যই আসবে যেদিন “সাহিত্যে নারী”- এ কথাটির বিলুম্প্তি ঘটবে। সাহিত্য হবে সার্বজনীন। লেখক হবেন সবার যেখানে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।
Share the Post:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *